সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে কিছু ভাবনা

বর্তমান সময়ে দাড়িয়ে যখন আমরা মানব সভ্যতার প্রেক্ষাপটে সামান্য পেছন ফিরে তাকাই, আমাদের মধ্যে অনেকেই গর্বিত বোধ করেন। গর্ব অনুভব করাটাই স্বাভাবিক। বিবর্তনের পথ ধরে আমরা আজ যে সন্ধিক্ষনে এসে দাড়িয়েছি, ইতিহাস তার সাক্ষী। একসময় ছিল যখন আমাদের পৃথিবীর আকার আর আকৃতির ধারনা করা কঠিন মনে হত। আর আজ আমরা সৌরজগত পেরিয়ে অংকের রাশিমালাকে বিস্তৃত করেছি মহাবিশ্বের সন্ধানে ।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। প্রশ্ন থেকে যায় সভ্যতাকে নিয়ে, সভ্যতার প্রকৃতি নিয়ে। একদিকে একদল মানুষ মঙ্গল গ্রহে পাড়ি দিতে প্রস্তুত হয়। আর অন্যদিকে আরেকদল মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় ছটফট করে। প্রশ্ন হতেই পারে যে, সভ্যতার মানদন্ডে কোন বিষয়টি প্রাধান্য পাবে ?

খাদ্য, বস্ত্র আর বাসস্থান এই তিনটে চাহিদাকে কোন অবস্থায়ই অগ্রাহ্য করা যায় না । কিন্ত বাস্তব সত্য হচ্ছে এই যে সভ্যতার শিখরে দাড়ানোর অহঙ্কারে আমরা অনেককিছুই না দেখার ভান করি । আজ মানব প্রজাতির ১০০ মিলিয়ন সদস্য গৃহহীন। প্রতিরাত্রিতে ১.০২ বিলিয়ন সদস্য না খেয়ে শুতে যায়। প্রতিবছর ১১ মিলিয়ন শিশু পাঁচ বছর পূর্ণ হওযার আগেই দারিদ্রতা জনিত কারণে মৃত্যুর শিকার হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই শোষণ ও বঞ্চনা কি সভ্যতার অগ্রগতিতে এক অপরিহার্য পরিপূরক? প্রশ্নের উত্তর অনেকটাই নির্ভর করে আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির উপর। মানব সভ্যতার ইতিহাসে শোষণ ও বঞ্চনা কোনো নতুন বিষয় নয়। বরং সভ্যতার এক ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু কোনো কিছু ঐতিহাসিক সত্য বলেই কি একে মেনে নেওয়া উচিত ? নিশ্চই নয়। মানব সভ্যতার স্বরূপ ও ভবিষ্যত নির্ধারণ হওয়া উচিত মানবতার মুক্তির (লিবারেশন) মধ্য দিয়ে।

একবিংশ শতাব্দিতে আসা পর্যন্ত আমরা সমস্ত ভৌগলিক দূরত্বের অবসান ঘটিয়েছি । নজির বিহীন সব সমস্যার সমাধান করেছি। মহাকাশে পাড়ি দিয়েছি সে তো অনেক দিন হল। কিন্তু এই চমকপ্রদ সাফল্যের ফল আমরা সবার কাছে পৌঁছাতে পারিনি। উন্নয়নের ফসল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপেক্ষাকৃত ধনী দেশের কুক্ষিগত। আর গরিব দেশগুলোতে বেড়ে চলেছে সীমাহীন আর্থসামাজিক বৈষম্য। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মানদন্ডে এক গরিব দেশ।

স্বাধীনতার প্রায় ৬৬ বছর পূর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু এখনো আমরা ভারতীয় আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনাকে কোন পথে পরিচালনা করব তা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। অনেকেই লাগামহীন দুর্নীতিকে বর্তমান ভারতের হতাশাজনক পরিস্থিতির কারণ মনে করেন। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। ভারতীয় ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের জন্য যে সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন সেটা হয়তো অনেকের কাছেই আকাঙ্খিত নয়। এবং এই অনাকাঙ্খাই বর্তমান হতাশার সৃষ্টি করেছে। আমার মনে হয় যে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে বর্তমান সমস্যা গুলোকে আরো ভালো ভাবে বোঝা । বর্তমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থা ও চলমান বৈষম্যের বিষয়ে গভীর আলোচনা করা ও একটি সম্যক ধারনা তৈরি করা ।

কয়েকটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো সহজ হবে । ধরা যাক ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার কথা। আমরা দেখি যে সরকার থেকে শুরু করে প্রতিটি ব্যক্তি কোন না কোন সময়ে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ক্ষেদ প্রকাশ করেন । প্রত্যেক অবিভাবক চান যে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম উচ্চমানের শিক্ষা অর্জন করুক। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে, আমরা সচরাচর শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে এমন কোন আলোচনা করিনা যা সমস্ত সমাজের এবং ব্যক্তির নিজের উন্নয়নের পরিপূরক হোক ।

গত দশকে সরকারি এবং বেসরকারী স্তরে আমরা শিক্ষার উন্নয়নে বেশ কিছু কাজ করেছি, যা প্রশংসার দাবি রাখে। ২০০৫ সালে National Council of Educational Research and Training (NCERT)র প্রকাশিত  জাতীয় পাঠ্যক্রমের রূপরেখা (National Curriculum Framework) এক গুরত্বপূর্ণ দলিল। জাতীয় পাঠ্যক্রমের রূপরেখা ২০০৫, ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য অনেকগুলো গঠনমূলক প্রস্তাব দিয়েছে । অবশ্য এই প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নের জন্য চটজলদি কোন সমাধান নেই।

শিক্ষা সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। Freire তার বিখ্যাত বই Pedagogy of the oppressedএ দেখিয়েছেন যে শিক্ষাকে সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণী তাদের শোষণ বজায় রাখার এক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে । Freireর দৃষ্টিভঙ্গি ও জাতীয় পাঠ্যক্রমের রূপরেখা কে একসাথে রেখে দেখলে অনেককিছুই নতুন করে ভাবতে হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুকে নিজের মত করে শেখার জায়গা দিচ্ছি না। এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তোতাকাহিনীর পরাধীন তোতাপাখি ।আড়ম্বরের ঘনঘটায় সব কিছু প্রাধান্য পায়, শুধু হারিয়ে যায় গুণগতমানের শিক্ষা।

শিক্ষার্থীদের শেখানোর মাধ্যম হবে মাতৃভাষা । এ কে না জানেন। কিন্তু আমরা আমাদের শিশুদের জোর করে ঠেলে দিচ্ছি এমন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে শিশু তার মাতৃভাষায় ভাবপ্রকাশের কোনো সুযোগই পাচ্ছে না। আমার বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে শিশুদের ভাবপ্রকাশকে শুধু ওদের মাতৃভাষার মধ্যেই সীমিত করা উচিত। আমার বক্ত্যব হচ্ছে যে শিশুকে শেখানোর মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। এমনকি মাতৃভাষায় শিশু অন্যান্য ভাষাও শিখবে ।

আর এক ভুল সিদ্ধান্ত হচ্ছে ছোটবেলা থেকে শিশুকে তথ্যে ঠাসা বই মুখস্থ করানো । শিশুকে নিজে থেকে কোন কিছু আবিষ্কার করার কোন অবকাশ পাঠ্যক্রমে নেই । এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমরা তথ্যকেই জ্ঞান ভাবছি। কিন্তু তা তো নয় । এই প্রসঙ্গে আমার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়এর এক লেখার কথা মনে হচ্ছে। বিভূতিভূষণ এর মতে দেশ আবিস্কারের জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে যেতেই হবে তা নয়। যে নতুন জায়গায় গেলাম আর সেখানকার সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম তাতেই দেশ আবিষ্কারের আনন্দ পাওয়া যেতে পারে। পাঠ্যক্রমে এবং বিদ্যালয় শিক্ষায় এটা সুনিশ্চিত করা দরকার যে শিশুর স্বাভাবিক রচনাশক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শিক্ষার উদ্দেশ্য কে পাঠ্যক্রমে যতচিত ভাবে উপস্থাপন করা। শিশুকে কি শেখানো হবে, কি করে শেখানো হবে, আর কি করেই বা ওদের মূল্যায়ন করা হবে এগুলো সব নির্ভর করে আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য কি তার উপর। যেমন, আমরা যদি পরবর্তী প্রজন্মকে শুধুমাত্র ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার প্রস্তুত করার জন্য ভাবি তাহলে পাঠ্যক্রমে নির্দিষ্ট বিষয় রাখা হবে। সেই মত পরীক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের সমাজে কি সবাইকে শুধু ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারই হতে হবে? আরও বড় প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় কি আমরা ভালো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার পাচ্ছি? এইপ্রশ্নগুলো যে কোনো শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে বলা যেতে পারে । এবং এইসব ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট ভাবার অবকাশ রয়েছে।

যে কোনো সামাজিক পরিবর্তনের জন্য উপযোগী শিক্ষার প্রয়োজন । শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র একটি বিশেষ গুষ্টিকে সামাজিক সম্পদের অধিকারী করে তোলা নয় । শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে মানবতার মুক্তি। Freireর ভাষায় আমরা বলব liberation। বিষয়টি খুব একটা সহজ নয়, অবশ্য অসম্ভব ও নয়। এর জন্য চাই সতত প্রয়াস। প্রয়াস সমাজ ও নিজেকে জানার। আর এর দায়িত্ব আমাদের সকলের।

Source: Uttaran – 2013: A yearly publication of Growing Seeds

4 thoughts on “সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে কিছু ভাবনা”

  1. bhaloi kotha koichot, amra jara education niya , somaj niya bhavi amra bhaivva jai , asole amader politician ra educated na hoile desh ta egye jaito na , noi le amader desher moto r desh ace,
    govt project guka dekhle matha kharap hoiya jay.
    5pass 8 pass koira nijer naam likte pare na,
    teacher ra left hand e leikkha student re pass koray
    ei hoilo amader education system, rega system(somaj bhabosta)

  2. Asit, you have made a very important point. However, I think we have to work together. Remember, public perception of what is education is also not satisfactory.
    “আড়ম্বরের ঘনঘটায় সব কিছু প্রাধান্য পায়, শুধু হারিয়ে যায় গুণগতমানের শিক্ষা।”

  3. The problem is with the foreground. What is the purpose of education? We are treating education to be only utilitarian, and hence if we find some other mode of providing or obtaining the utility then we completely ignore the education. And this is a global phenomenon, cutting across class, region or gender.

    Take the poor in India, the parents prefer the girl to stay at home and provide utility there instead of gaining any utilitarian skills at school, because it can not be translated into tangible utility that they perceive is needed for the girl’s life. The boys are not sent to school for the same reason, they are much more utilitarian if they work instead of gaining education.

    In general, education is synonymous to the degree, and getting the degree is more important than getting educated. This leads to unfair practices being the norm in the assessment process. Post the degree / qualification the education is lost in the quagmire of practical life and competition.

    In many business based community in India the girls are discouraged from aspiring for higher studies as it is not utilitarian, and getting a groom becomes more expensive. The boys are also discouraged from gaining education as it dos not translate into tangible gains in the family business.

    For the higher strata of the society, the purpose of education is simply utilitarian. Any aspect that can not be directly translated into material wealth or liquid cash is simply not worthwhile pursuing.

    Hence, if you ask me, the real problem of education today lies outside the direct purview of education, and is indeed very difficult to solve, as changing the foreground requires a revolution of a different order.

Leave a comment